ব্রেকিং: সেনা কর্মকর্তার সাথে শেখ হাসিনার নতুন অডিও
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান চলাকালে টেলিফোনে তার ব্যক্তিগত সামরিক কর্মকর্তাকে ছাত্রদের ওপর সরাসরি গুলি করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, মিরপুর, বাড্ডা, উত্তরা ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে ওরা জড়ো হচ্ছে। এখনই গুলি চালিয়ে দমন করার ব্যবস্থা করো, তাহলে অন্যরা আর আসবে না। ‘এবারে কোনো কথা নেই, এবারে শুরুতেই দিবা’ (অর্থাৎ শুরুতেই গুলি করো)। আমার দেশ-এর ধারাবাহিক অনুসন্ধানে এ তথ্য জানা গেছে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলি চালানোর ব্যবস্থা করতে টেলিফোনে এ নির্দেশ দেন তার উপসামরিক সচিব (ডিএমএসপিএম) কর্নেল জিএম রাজীব আহম্মেদকে। এর আগে তিনি শেখ হাসিনার সহকারী সামরিক সচিব (এএমএসপিএস) ছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও কর্নেল রাজীবের মধ্যে ওই টেলিসংলাপ আমাদের হাতে এসেছে। ওই ডকুমেন্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান জুলাই বিপ্লবের মানবতাবিরোধী অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হতে পারে। টেলিসংলাপটি পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে, এটি ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই-পরবর্তী সময়ের কথোপকথন।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাকে ‘ম্যাডাম’ না বলে ‘স্যার’ সম্বোধন করার নির্দেশনা জারি করেছিলেন। ফলে কর্নেল রাজীবের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় মনে হয়েছে, এটি ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই-পরবর্তী সময়ের কথোপকথন।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাকে ‘ম্যাডাম’ না বলে ‘স্যার’ সম্বোধন করার নির্দেশনা জারি করেছিলেন। ফলে কর্নেল রাজীবের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় শোনা যায়, রাজীব বারবার ‘জি স্যার’, ‘জি স্যার’ বলছেন। টেলিফোনে কথা বলার সময় শেখ হাসিনা কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে সমন্বয় করে গুলি চালিয়ে মারার (গণহত্যার) নির্দেশ দেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের ওই অবৈধ নির্দেশ পালন করে কর্নেল জিএম রাজীব আহম্মেদও অপরাধে জড়িয়েছেন। ওই নির্দেশ তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়ে গুলি করার বিষয়টি সমন্বয় করেন। কিন্তু দুঃখজনক খবর হচ্ছে, শাস্তির আওতায় আনার পরিবর্তে অপরাধী এই সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল রাজীবকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দক্ষিণ সুদানে কমান্ডার হিসেবে নিয়োজিত করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে দক্ষিণ সুদানে রয়েছেন এবং আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ সময়কালে মিশন শেষ করে তার বাংলাদেশে ফেরত আসার কথা রয়েছে। এ ঘটনা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনাসদস্যদের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। তারা অবিলম্বে বিতর্কিত এই সামরিক কর্মকর্তাকে শান্তিরক্ষা মিশন থেকে প্রত্যাহারের পরামর্শ দিয়ে বলেন, নইলে এ ঘটনা বাংলাদেশের জন্যে বড় বিপদ এবং হুমকি ডেকে আনবে।
গুমের অভিযোগে অভিযুক্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিব (মিলিটারি সেক্রেটারি) মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদকেও রাষ্ট্রদূত করে সেনাবাহিনী থেকে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে তাকে রাষ্ট্রদূত করার কথা জানানো হয়। তিনি যতদিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কোনো মিশনের দায়িত্ব না পাচ্ছেন, ততদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েই থাকবেন।
এক সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা কবীর আহাম্মদ ২০২২ সালের মার্চে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিবের দায়িত্ব পান। ওই বছরের ২০ জুলাই পদোন্নতি পেয়ে তিনি মেজর জেনারেল হন।
বিএমএর ২৪তম লং কোর্সে কমিশন পাওয়া কবীর আহাম্মদ সিলেট সেনানিবাসের ১১ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (সিটিআইবি) পরিচালক ছিলেন তিনি।
মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মেদের বিরুদ্ধে গুমসংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। গুম কমিশনে বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে।
রাষ্ট্রদূত হওয়া আরেক সেনা কর্মকর্তা হলেন মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন। তিনিও ডিজিএফআইয়ের পরিচালক ছিলেন। ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং এরিয়া কমান্ডার হিসেবে কাজ করেন। শেখ হাসিনার পতনের আগে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
এই দুই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুমের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। গুম কমিশন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে যাচ্ছে। ইতঃপূর্বে তাদের অপরাধের বিষয়ে সেনা সদরকেও অবহিত করা হয়।
শেখ হাসিনা ও কর্নেল রাজীবের টেলিফোন কথোপকথন নিম্নরূপ
শেখ হাসিনার উপসামরিক সচিব কর্নেল রাজীব হাসিনার ফোন ধরেই বলেন, ‘আসসালামুআলাইকুম স্যার’। শেখ হাসিনা সালামের জবাব না দিয়েই নির্দেশনা দিতে শুরু করেন। ছাত্ররা মিরপুর ১০, বাড্ডা, উত্তরা ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এলাকায় জড়ো হচ্ছে। তারা বেশি সংখ্যায় জড়ো হওয়ার আগেই যেন তাদের ওপর গুলি করা হয়। তাহলে তারা আর জড়ো হতে সাহস পাবে না। গলির ভেতরে চলে যাবে।
ফোনালাপের পুরো সময় কর্নেল রাজীব ‘জি স্যার, জি স্যার’ বলে নির্দেশনা গ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, শুরুতেই অ্যাকশনে যেতে হবে। নতুবা ওরা জমা হতে থাকবে। অল্প জমা অবস্থাতেই দ্রুত কাজ করতে হবে। কর্নেল রাজীব ‘জি স্যার, জি স্যার’ বলে সায় দেন।
এ সময় শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, এবার আর কিন্তু কোনো কথা নেই। গুলি করার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, এবার একেবারে শুরুতে দিবা।
এ পর্যায়ে কর্নেল রাজীবও ঠিক আছে বলে সায় দেন এবং ‘স্যার, আসসালামুঅলাইকুম’ বলে ফোন রাখেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপসামরিক সচিব কর্নেল রাজীবের মাধ্যমে শেখ হাসিনা যে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালানোর নির্দেশ দিতেন, ফোনালাপের ওই অডিও তারই একটি প্রমাণ।
এর আগে আমার দেশ-এ ফাঁস হওয়া আরেকটি অডিওতে শোনা যায়, চব্বিশের ৫ আগস্ট পালানোর আগ মুহূর্তে কর্নেল রাজীব টেলিফোন করেন সালমান এফ রহমানকে। রেহানা আপা কথা বলবেন বলে শেখ রেহানাকে ফোন ধরিয়ে দেন। ধারণা করা হয়, পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে হেলিকপ্টার থেকে ফোন করেছিলেন তিনি। ওই ফোনকলে শেখ রেহানা দ্রুত সালমানকে বাসা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কর্নেল রাজীব শেখ হাসিনার পাশাপাশি শেখ রেহানারও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ঘনিষ্ঠ ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের। শেখ হাসিনাকে ভারতে রেখে আসার দলেও ছিলেন কর্নেল রাজীব।
অথচ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তার প্রমোশন হয়েছে এবং প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে তাকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দক্ষিণ সুদানে কামান্ডার হিসেবে পাঠানো হয়েছে। মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও অনুগত এই সামরিক কর্মকর্তাকে
আওয়ামী সমর্থক হিসেবে সরকারের স্পর্শকাতর জায়গায় পদায়ন করা হয়েছিল। আগামী মার্চে তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
Comments
Post a Comment